সৌভাগ্য ছুঁড়ে মারার এক অনন্য উৎসব
সাত রঙ ডেস্ক ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকমপ্রকাশিত: ১২:৫৩ ২৭ জানুয়ারি ২০২১ আপডেট: ১৩:২৯ ২৭ জানুয়ারি ২০২১

ছবি: সংগৃহীত
যদি প্রশ্ন করা হয়, বেলজিয়াম কিসের জন্য বিখ্যাত, তবে নিঃসন্দেহে একাধিক উত্তর আসবে। বেলজিয়ামের চকলেট, বর্ণময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহ্যবাহী খাবার, এমনকি বেলজিয়ামের বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বিয়ারের কথাও আসতে পারে। উৎসবপ্রেমীদের জন্যও বেলজিয়াম বেশ আনন্দের জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
বেলজিয়াম যেসব বর্ণীল জমকালো উৎসবের জন্য বিখ্যাত, তার মধ্যে কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ ঐতিহ্য ও জাঁকজমকের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেলজিয়াম দেশটিতে মূলত ওলন্দাজ এবং ফরাসি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। এই দুই শ্রেণি মিলে সেখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ দখল করে আছে। এই দেশের দক্ষিণ ও পূর্বের ওয়ালোনিয়া অঞ্চলে মূলত ফরাসিরা বসবাস।
এই ফরাসিরাই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ‘দ্যু বাশ্চ’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী জমকালো উৎসবে মেতে ওঠেন। তিন দিনব্যাপী এই উৎসবেই সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে তারা একে অপরের দিকে কমলা লেবু ছুঁড়ে থাকেন। খ্রিস্টানদের উৎসব অ্যাশ ওয়েন্সডে চলার সময় বেলজিয়ামের ওয়ালোনিয়ার বাশ্চ এলাকায় এই উৎসব পালন করা হয়।
কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ সাধারণত তিন দিন ধরে উদযাপিত হয়ে থাকে। বিশেষ খ্রিস্টিয় উৎসব ‘শ্রভ সানডে’ এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক শুরু হিসেবে বিবেচিত হয়। এদিনে ড্রাম ও ভায়োলার মতো বাদ্যের সুমধুর সুরে আকাশ-বাতাস আলোড়িত হতে থাকে। প্রথমদিনের মিছিলে অংশগ্রহণকারী পুরুষ ও নারীরা সমকালীন বিভিন্ন ঘটনাবলী ও চরিত্রের আদলে সজ্জিত হন।
এদিনের কস্টিউম সাধারণত সকল সদস্যের জন্য অভিন্ন হয়ে থাকে। উৎসবের শুরুর দিন হিসেবে এই দিন উৎসাহ আর উদ্দীপনার ক্ষেত্রে অনন্য হয়ে থাকে। এই উৎসবে নারী ও পুরুষ উভয়ই অংশগ্রহণ করে থাকে, তবে পুরুষদের আধিক্য এবং প্রাধান্য বেশি দেয়া হয় এই উৎসব পালন করার ক্ষেত্রে। এটি শুরু হয় রবিবার, সেই দিনটিকে বলা হয় শ্রভ সানডে।
এই দিনটিতে সাধারণত একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নারী-পুরুষরা আনন্দে মেতে ওঠেন। এই উৎসবের দ্বিতীয় দিন শ্রভ মনডে নামে পরিচিত। এই দিনটি মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। এই দিন উৎসবমুখর জনতাকে রঙিন কাগজ দিয়ে এমনভাবে ভরিয়ে দেয়া হয় যেন মনে হবে রঙিন জমকালো কাগজের বৃষ্টি নেমেছে।
এই দিনে স্থানীয় চার্চগুলো তাদের চিরাচরিত ভাবগম্ভীর পরিবেশে ত্যাগ করে অনেক খোলামেলা হয়ে ওঠে, প্রতিটি চার্চে পিয়ানো বেজে ওঠে। এই উৎসবের তৃতীয় অর্থাৎ শেষ দিন শ্রভ টিউসডে নামে বিখ্যাত। এই দিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উৎসবের ক্ষেত্রে। এই দিন এখানকার পুরুষরা সবাই একটি বিশেষ পোশাক পড়ে। সেই পোশাকের অঙ্গ হিসেবে গোঁফ আঁকা মোমের মুখোশে সবাই মুখ ঢেকে থাকে।
এই পোশাক পরিহিত প্রতিটি পুরুষ সদস্যকে বলা হয় ‘গিলে’। উৎসবের শেষ দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রতিটি গিলে সদস্য এই বিশেষ পোশাক পড়ে যে যার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। এই সময় তারা ড্রামের তালে তালে পা মিলিয়ে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হন। দেখলে মনে হবে যেন রাত্রিকালীন প্যারেড চলছে! উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক সকাল ৭ টার সময় তারা ওস্টার নামে শামুকের একরকম পদ এবং শ্যাম্পেন সহযোগে প্রাতরাশ সম্পন্ন করেন একত্রে।
এই অনুষ্ঠানে নারীরাও একটি বিশেষ পোশাক পড়ে তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে শামিল হন। বিশেষ পোশাক পরিহিত নারীদের বলা হয় ‘প্যাসেন’। সমস্ত গিলে এবং প্যাসেন সদস্যরা বেলার দিকে শহরের টাউন হলের সামনে সমবেত হন। তখন মেয়র টাউন হল থেকে বেরিয়ে এসে সমবেত জনতার মধ্যে থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের গলায় মেডেল পরিয়ে দেন। দুপুর তিনটের সময় শহরের টাউন হলের সামনে থেকে বিশেষ নির্বাচিত এক হাজার জন গিলে সদস্যের মিছিল বের হয়।
এই বিশেষ মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি গিলে সদস্যের মাথায় প্রায় তিন কেজি ওজনের দেড় মিটার উচ্চতার সুবিশাল উট পাখির পালকের তৈরি টুপি পরা থাকে! মাঝবয়সী একজন পুরুষ এই মিছিলে অংশ নিতে যথাসাধ্য খরচ করে থাকেন। শুধুমাত্র উটপাখির পালকে তৈরি হ্যাটটিরই দাম পড়ে ন্যূনতম প্রায় এক হাজার ইউরো। এই সুবিশাল টুপি পরিহিত মিছিলে অংশগ্রহণ করা স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ফরাসিদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের। এই মিছিলের শেষেই সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ পরস্পর পরস্পরের দিকে কমলালেবু ছুড়তে থাকেন।
যদিও এই কমলালেবু ছোঁড়ার নিয়ম হচ্ছে কাউকে আঘাত করা যাবে না। একসময় চারিপাশ কমলালেবুর রসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কমলালেবু ছোঁড়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যের দিক থেকে সারা রাত জুড়ে নাচ গান এবং পানাহার পর্ব চলে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে। পরের দিন সূর্যের আলো ফোটার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এই উৎসব সেই বছরের মতো সমাপ্ত হয়। বেলজিয়ামের ওয়ালোনিয়া অঞ্চলের ফরাসি অধিবাসীরা বেশ অনেকদিন আগে থেকেই এই উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে দেন। এই উৎসবের জন্য নিজেদের মধ্যে রিহার্সাল পর্যন্ত দিয়ে থাকেন ওয়ালোনিয়া অঞ্চলের অধিবাসীরা।
ডেইলি বাংলাদেশ/এসএ